তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন — বাস্তবতা, ইতিহাস, কাজের প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন (Wireless Power Transmission) বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা — টেসলা থেকে শুরু করে আধুনিক ওয়্যারলেস চার্জিং পর্যন্ত।

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন (Wireless Power Transmission) — বাস্তবতা, ইতিহাস, কাজের প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

লেখক: Arifin Akash | আপডেট:

ওয়্যারলেস বিদ্যুৎ পরিবহন: টেসলার যুগ থেকে আধুনিক Qi চার্জিং পর্যন্ত।

ভূমিকা

কল্পনা করুন, আপনি ঘরে ঢুকলেন এবং আপনার ফোন, ল্যাপটপ, স্মার্টওয়াচ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হতে শুরু করল—কোনো তার নেই, কোনো প্লাগ নেই! এই স্বপ্ন আজ আর কল্পনা নয়; বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন যা বাতাসের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তির নাম — তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন বা Wireless Power Transmission (WPT)

এই প্রযুক্তি আধুনিক সমাজে বিপ্লব ঘটাতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটি কিভাবে সম্ভব? কতটা নিরাপদ? এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাব কী হতে পারে? চলুন ধাপে ধাপে বিস্তারিত জানি।

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহনের ইতিহাস

এই ধারণার সূচনা হয় ১৯শ শতকের শেষ দিকে। এর জনক বলা হয় নিকোলা টেসলা (Nikola Tesla)-কে। তিনি ১৮৯১ সালে আবিষ্কার করেন Tesla Coil — যা দিয়ে দূরবর্তী স্থানে চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রেরণ করা সম্ভব হয়েছিল।

১৯০১ সালে টেসলা শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত প্রকল্প Wardenclyffe Tower। এর লক্ষ্য ছিল সারা পৃথিবীতে তার ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর নিজস্ব পরিবাহী বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক শক্তি তার ছাড়া ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

যদিও অর্থাভাবে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়, তবে টেসলার এই গবেষণা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। আজকের ওয়্যারলেস চার্জিং, মাইক্রোওয়েভ পাওয়ার ট্রান্সমিশন—সবই টেসলার চিন্তার ফলাফল।

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহনের মৌলিক নীতি

তারবিহীন বিদ্যুৎ পরিবহন মূলত তিনটি পদ্ধতিতে কাজ করে:

  1. Electromagnetic Induction (চৌম্বকীয় প্রভাব): দুটি কয়েল কাছাকাছি থাকলে প্রেরণকারী কয়েল থেকে উৎপন্ন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র গ্রহণকারী কয়েলে বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করে।
  2. Resonant Inductive Coupling: একই ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করা দুটি কয়েল বেশি দূরত্বেও শক্তি পরিবহন করতে পারে।
  3. Microwave / Laser Transmission: মাইক্রোওয়েভ বা লেজার রশ্মির মাধ্যমে শক্তি কয়েক কিলোমিটার দূরেও পাঠানো যায়।

উদাহরণস্বরূপ, Qi ওয়্যারলেস চার্জার ফোনের সাথে কয়েক মিলিমিটারের দূরত্বে কাজ করে; অন্যদিকে মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিশন কয়েক কিলোমিটার দূরত্বেও শক্তি পাঠাতে সক্ষম।

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহনের ধরন

পদ্ধতি কাজের নীতি দূরত্ব ব্যবহার
Inductive Coupling চৌম্বকীয় প্রভাবের মাধ্যমে শক্তি স্থানান্তর ১–৫ সেমি মোবাইল চার্জার, টুথব্রাশ
Resonant Coupling অনুরণন ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে ১–৩ মিটার EV চার্জিং, রোবটিক্স
Microwave / Laser রশ্মির মাধ্যমে শক্তি প্রেরণ কয়েক কিলোমিটার স্যাটেলাইট, ড্রোন, মহাকাশ

প্রয়োগ ক্ষেত্র

  • স্মার্টফোন ও ওয়্যারলেস চার্জার: আধুনিক Qi চার্জিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
  • ইলেকট্রিক ভেহিকেল (EV): গাড়ির নিচে চার্জিং প্যাড বসিয়ে চার্জ করা যায়।
  • মেডিক্যাল ইমপ্ল্যান্ট: শরীরে থাকা ডিভাইস যেমন পেসমেকার নিরাপদে চার্জ করা যায়।
  • ড্রোন ও রোবোটিক্স: দূর থেকে শক্তি পাঠিয়ে চার্জ রাখা সম্ভব।
  • মহাকাশ ভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ: মহাকাশে সংগৃহীত শক্তি মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠানো।

সুবিধা

  • কোনো তার বা প্লাগের প্রয়োজন নেই।
  • যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি কমে, স্থায়িত্ব বাড়ে।
  • জল ও ধুলা থেকে সুরক্ষা বৃদ্ধি পায়।
  • ডিজাইন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্থাপনা সহজ হয়।

অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা

  • দূরত্ব বাড়লে শক্তি ক্ষতি বেড়ে যায়।
  • রেডিয়েশন সেফটি মানা না হলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।
  • উচ্চমূল্য ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এখনো রয়ে গেছে।

নিরাপত্তা দিক

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহনে ব্যবহৃত রশ্মি (Electromagnetic Field) বা মাইক্রোওয়েভ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকলে তা নিরাপদ। আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ICNIRPIEEE এর নির্দেশিকা অনুসারে এই সীমা নির্ধারণ করা হয়। সঠিক ডিজাইন ও শিল্ডিং থাকলে ঝুঁকি অনেক কম।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

আগামী দশকে বিজ্ঞানীরা এমন এক পৃথিবীর কল্পনা করছেন যেখানে পুরো ঘর, অফিস বা রাস্তাই হবে ওয়্যারলেস পাওয়ার নেটওয়ার্ক। আপনি ঘরে ঢুকলেই আপনার ডিভাইস স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হবে।

কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন WiTricity, Energous, এবং Xiaomi ইতিমধ্যে এ বিষয়ে বাণিজ্যিক পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। এমনকি NASA মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে বিদ্যুৎ পাঠানোর গবেষণাও করছে।

FAQ — সাধারণ প্রশ্নোত্তর

১. তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন কত দূর পর্যন্ত সম্ভব?

Inductive Coupling সাধারণত কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত কার্যকর, কিন্তু মাইক্রোওয়েভ বা লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত শক্তি পাঠানো সম্ভব।

২. এটি কি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর?

নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে এটি নিরাপদ। তবুও উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি বা উচ্চ শক্তির রশ্মির ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন।

৩. এটি কি ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ তারের বিকল্প হতে পারে?

সম্পূর্ণ বিকল্প নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই তারের প্রয়োজন কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে স্মার্ট হোম, হাসপাতাল ও ইভি চার্জিং ক্ষেত্রে।

উপসংহার

তার ছাড়া বিদ্যুৎ পরিবহন মানব সভ্যতার এক বড় প্রযুক্তিগত অর্জন। টেসলার কল্পনা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। যদিও এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবু বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবন করছেন। ভবিষ্যতে হয়তো এমন এক সময় আসবে, যখন বিদ্যুৎও Wi-Fi-এর মতো সহজলভ্য হয়ে উঠবে।

Mathologys

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার মতামত বা প্রশ্ন নিচের কমেন্টে জানান।


লেখক পরিচিতি:

আরিফিন আকাশ
প্রভাষক(গণিত)
Mathcheap ও Mathologys এর স্বত্বাধিকারী
গণিত, বিজ্ঞান, ও প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক।
ওয়েবসাইট: www.mathcheap.com এবং www.mathologys.com
Facebook: facebook.com/mathcheap

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন